গ্রীষ্মের দুর্বিষহ তাপ থেকে আমাদের মুক্তি দিতে বর্ষা খুব তাড়াতাড়ি আসতে চলেছে। যদিও আমরা তাপমাত্রার এই পরিবর্তনকে আগমন জানাব, তবে বর্ষাও তার সঙ্গে তার অংশের দুর্ভোগ নিয়ে আসে। বর্ষাকাল প্রায়শই তার সঙ্গে ফ্লু, কাশি, সর্দি, দুর্বল হজমের সমস্যার মতো শারীরিক অসুখগুলোকে নিয়ে আসে। এছাড়াও, বর্ষার সাথে, হঠাৎ করেই মাছি এবং মশার সংখ্যা অনেক বেড়ে যায় যা আমাদের ম্যালেরিয়া, জন্ডিস, ডেঙ্গু, আমাশয় টাইফয়েড, কলেরা এবং লেপটোস্পাইরোসিস ইত্যাদি রোগে আক্রান্ত করে…
তাই, এই বর্ষাকালে এই স্বাস্থ্যকর পরামর্শগুলি অনুসরণ করে সতর্ক থাকুন এবং সাবধানে থাকুন:
● কোনো বাইরের খাবার নয়
রাস্তার খাবার থেকে দূরে থাকুন, জাঙ্ক ফুড যেমন স্যান্ডউইচ, পকোড়া, ভাজি, ফুচকা ইত্যাদি, কারণ এতে ব্যাকটেরিয়া থাকে যার থেকে বদহজম হতে পারে। যে কোনো ধরনের আগে থেকে কাটা বা কাঁচা খাবার/ফল খাওয়া থেকে বিরত থাকুন কারণ এতে জীবাণু থাকে যা আমাদের খাবারের বিষক্রিয়ার কারণ হয়। কখনোই বাইরের জল পান করবেন না কারণ দূষিত এবং অপরিষ্কার জল থেকে জল বাহিত রোগ যেমন কলেরা, আমাশয় ইত্যাদি হতে পারে।
● সবুজ এবং রঙিন ফল ও শাকসবজি খান
বর্ষাকালে রোগ জীবাণু এড়াতে এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে সবুজ এবং রঙিন ফল ও শাকসবজি খাওয়া বাধ্যতামূলক। এই খাবারগুলিতে রয়েছে সেই সমস্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টিগুণ যা আপনার রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় এবং আপনাকে এইরকম রোগ-প্রবণ ঋতুতে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। যাইহোক, এই ঋতুতে আপনাকে এই ফল বা শাকসবজিগুলি ধোবার সময় (বিশেষ করে যেগুলি স্যালাড এর জন্য ব্যবহার করা হয়) অতিরিক্ত সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে। আদর্শভাবে, ময়লা সরানোর সবথেকে ভালো উপায় হল লবণ দিয়ে উষ্ণ গরম জলে এগুলোকে ধোয়া।
● ঘরের তাপমাত্রায় সংরক্ষিত করা বা পরিবেশন করা খাবার এড়িয়ে চলুন
ঘরের তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করা বা পরিবেশন করা খাবার এড়িয়ে চলুন। রান্না করা গরম খাবার সবথেকে ভালো। এবং যদিও কোন নিশ্চয়তা নেই যে ভালো ভালো রেস্তোরায় পরিবেশন করা খাবারগুলি সুরক্ষিত হবে। সবথেকে ভালো হয় রাস্তার বিক্রেতাদের কাছ থেকে খাবার এড়িয়ে চলা কারণ এর থেকেই বেশি দূষণ ছড়ায়। পাওয়ার অফ হওয়ার সময়ে আপনার রেফ্রিজারেটর এবং ফ্রিজারের দরজা পুরোপুরি বন্ধ রাখুন- খাবার ৮ ঘন্টা পর্যন্ত সতেজ থাকবে।
● মশাকে বাড়ি থেকে দূরে রাখুন
বর্ষা শুরু হওয়ার পরপরই এদের আগমন ঘটে কারণ বাড়ির চারপাশে তাজা জল জমে থাকে। আপনার পাশে মশার কয়েল রেখে ঘুমানোর থেকে দরজা ও জানলায় মশারি ও মশারির জাল লাগানো বেশি ভালো উপায়।
মশা তাড়ানোর ক্রিমের ব্যবহারও একটি ভালো উপায় এবং তার সাথে আমাদের ত্বকের বেশি অংশ না দেখা যায় এরকম পোশাক পরাও ভালো ধারণা।
● আপনার বাড়ি ও তার চারপাশ পরিষ্কার ও কীটপতঙ্গ মুক্ত রাখুন
আপনার বাড়িটিকে একটি পোকামাকড় মুক্ত স্থানে পরিণত করুন। তার সাথে লক্ষ্য রাখুন কোন জায়গায় জমা বা ফুটো আছে নাকি। ওয়াটার কুলার, ফুলের টব বা অন্যান্য জায়গা থেকে জল জমে আছে নাকি তা খুঁটিয়ে দেখুন। এটি মশাদের বংশবৃদ্ধি রোধ করতে পারে এবং এর ফলেই আপনি মশাবাহিত রোগের থেকে রক্ষা পেতে পারেন।
এখনও পর্যন্ত মশা রোধের সবথেকে ভালো পদ্ধতি হল ট্যাঙ্ক ও অন্যান্য জমা জলের উৎস থেকে তাদের দূরে রাখা। এছাড়াও, বৃষ্টির জলকে কোন পাত্রে বা ট্যাঙ্কের আউটলেট বা ট্যাপের নীচের তলায় জমা হতে দেবেন না, কারণ এটি একটি মশাদের প্রজনন স্থান হয়ে উঠতে পারে। বেশিরভাগ মশাই তারা যেখানে ডিম দেয় এবং বংশবৃদ্ধি করে, তার কাছাকাছি থাকে।
● বেশি করে জল পান করুন এবং হাইড্রেটেড থাকুন
আবহাওয়ার ঠান্ডা থাকা সত্বেও, এই বর্ষাকালে আপনাকে অনেক বেশি পরিমাণ জল পান করতে হবে। উচ্চ আর্দ্রতার কারণে, এই সময়ে আমাদের শরীর খুব বেশি ঘামে না, তাই শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেওয়ার জন্য বেশি করে জল পান করা খুব গুরুত্বপূর্ণ।
যাই হোক, আপনি যে জল পান করেন সেই সম্পর্কে আপনাকে আরো বেশি করে সতর্ক হতে হবে কারণ বর্ষাকালে বেশিরভাগ রোগই হয় জলবাহিত কারণে। আপনি জলে থাকা ক্ষতিকারক জীবাণু এবং অপরিষ্কার জিনিসকে দূর করতে জলটাকে ফুটিয়ে নিতে পারেন। পরিষ্কার ফোটানো জল পান করুন এবং সম্ভব না হলে বোতলের জল পান করুন।
● বৃষ্টিতে ভিজে গেছেন? সঙ্গে সঙ্গে স্নান করুন
আপনার শরীরকে জীবাণুমুক্ত করতে একটি আরামদায়ক উষ্ণ জলের স্নান করুন, কারণ এই সময়ে ত্বকে ছত্রাক জাতীয় সংক্রমণ বেশি মাত্রায় ঘটে। যদি সম্ভব হয়, নিজেকে সংক্রমণ মুক্ত রাখতে একটি ভেষজ শাওয়ার জেল বেছে নিন।
● টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস এ – এর টিকা
টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস এ বর্ষাকালে সাধারণভাবেই খুব বেশি মাত্রায় দেখা যায়। জনগণের স্বাস্থ্যরক্ষার লক্ষ্য হিসেবে এই রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে – নিরাপদ পানীয় জল, উন্নত স্যানিটেশন এবং পর্যাপ্ত পরিমাণ চিকিৎসা ব্যবস্থা – হয়তো এটি অর্জন করা কঠিন হবে। সেই কারণে, কিছু বিশেষজ্ঞ বিশ্বাস করেন যে উচ্চ-ঝুঁকিপূর্ণ জনসংখ্যার ক্ষেত্রে টিকা দেওয়া এই রোগগুলিকে নিয়ন্ত্রণ করার সবচেয়ে ভালো উপায়। আপনি যদি টাইফয়েড এবং হেপাটাইটিস এ বেশি হয় এমন জায়গায় ভ্রমণে যান, তাহলে আপনাকে একটি টিকার সুপারিশ করা হয়।
● ঘরে ব্যায়াম করুন
বর্ষাকালে বাড়ির ভেতরে ব্যায়াম করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদি আপনার ব্যায়ামের নিত্যদিনের সূচিতে জগিং বা হাঁটা যুক্ত থাকে, তাহলে পিলাটিস বা যোগব্যায়াম অনুশীলন করার চেষ্টা করুন বা বাড়ির ভিতরে যে কোনো ফ্রি-হ্যান্ড ব্যায়াম করুন।
● আপনার চোখক্র রক্ষা করুন
নোংরা হাতে আপনার মুখ এবং চোখ স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন। গরম জল এবং জীবাণুনাশক সাবান দিয়ে যত বেশি সম্ভব ঘন ঘন আপনার হাত ধুয়ে নিন। যখন জল পাওয়া যায় না তখন আপনার সাথে অ্যালকোহল- যুক্ত হ্যান্ড স্যানিটাইজার রাখুন। এটি আপনাকে চোখের সাধারণ সমস্যা যেমন কনজাংটিভাইটিস থেকে নিরাপদে রাখবে।
উপসংহার
- রাস্তায় বা জাঙ্ক ফুড খাওয়া এড়িয়ে চলুন।
- আপনি যখন বাড়ির বাইরে খাবারের পরিকল্পনা করছেন যদি আপনার প্রয়োজন হয় তাহলে সাথে ভালোভাবে সেদ্ধ ও রান্না করা খাবার রাখুন।
- রেস্টুরেন্টে বা হোটেলে সাধারণ জল পান করা থেকে বিরত থাকুন। সংক্রমণ এড়াতে ভিজে যাওয়ার সাথে সাথে স্নান করুন।
- খাদ্য তালিকায় আরো বেশি পরিমাণে ফল ও শাকসবজি যোগ করুন এবং এটাও নিশ্চিত করুন যেন খাওয়ার আগে সেটি ভালোভাবে ধোওয়া হয়।
তাই, স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস এবং জীবন যাপন পালন করে চলুন, এই বর্ষা ঋতুটিকে আপনার এবং আপনার প্রিয়জনদের জন্য সত্যিকারের জাদুতে ভরিয়ে তুলুন।