পর্যালোচনা
রিকেটকে কঙ্কালের ব্যাধি বা হাড়ের অবস্থা হিসাবে ভাবা যেতে পারে যা ভিটামিন ডি, ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের অভাবের কারণে বাচ্চাদের মধ্যেই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘটে। এগুলি শক্তিশালী এবং সুস্থ হাড়ের বিকাশের জন্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় পুষ্টি। রিকেটে আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাড় নরম হয় এবং হাড় সহজেই ভেঙে যাবার প্রবণতা থাকে এবং হাড়ের গঠন বিষমাঙ্গ প্রকৃতির হয়ে যায়, এমনকি সবচেয়ে গুরুতর ক্ষেত্রে কঙ্কালের বিকৃতির প্রবণতা দেখা দেয়। 1963 থেকে 2005 সালের মধ্যে ভারতের 22টি রাজ্য জুড়ে ছড়িয়ে থাকা 0.39 লক্ষ গ্রামে উপস্থিত 337.68 লক্ষ লোকের জন্য একটি সমীক্ষা চালানো হয়েছিল। হাড়ের ব্যাধি এবং খনিজ বিপাকের সাথে সম্বন্ধিত রোগে আক্রান্ত 411,744 রোগীর মধ্যে রিকেট ছিল সবচেয়ে পরিচিত ব্যাধিগুলির মধ্যে একটি। ভিটামিন ডি ক্যালসিয়াম শোষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে, এবং তাই শরীরে কম মাত্রায় ভিটামিন ডি থাকলে তা ক্যালসিয়াম শোষণের মাত্রা কমিয়ে দিতে পারে। এর ফলে বিকাশমান হাড় দুর্বল ও অসমাঙ্গ হয়ে পড়ে। আসুন আমরা রিকেট সম্পর্কিত লক্ষণ, এর কারণ, চিকিৎসা এবং অন্যান্য সমস্ত কিছু নিয়ে আলোচনা করি।
রিকেট এবং এর ধরন সম্পর্কে তথ্য
রিকেট একটি বিশ্বব্যাপী পরিচিত হাড়ের রোগ যা ফসফেট হোমিওস্টেসিস এবং ক্যালসিয়ামের ভারসাম্যহীনতার সাথে যুক্ত। এটি প্রায়শ শরীরের বামনাকৃতি এবং গাঁটের বিকৃতির দিকে পরিচালিত হয়। ফসফেট এবং ক্যালসিয়াম স্তরের উপর নির্ভর করে রিকেটগুলিকে বিস্তৃতভাবে দুটি প্রধান বিভাগে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়: ফসফরিক এবং ক্যালসিফিক। এখন, সঠিক রোগ নির্ণয় ও ব্যবস্থাপনার জন্য রিকেটের একটি নির্দিষ্ট কেস কোন বিভাগের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সে সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অপরিহার্য। পুষ্টির ঘাটতি জনিত কারণগুলিও রিকেটের একটি প্রকার এবং তাদের খাদ্যর মাধ্যমে ভিটামিন ডি সঠিকভাবে গ্রহণ করলে এবং সূর্যালোকের সংস্পর্শে এলেই সহজেই এটা প্রতিরোধ করা যায়। এছাড়াও রিকেটের অন্যান্য উপশ্রেণি আছে এবং সেগুলি হল:
1. ভিটামিন ডি নির্ভর টাইপ 1 রিকেট।
2. ভিটামিন ডি নির্ভর টাইপ 2 রিকেট।
উপরের দুটিই ভিটামিন ডি বিপাকের ত্রুটির কারণে ঘটে।
1. রেনাল রিকেট কিডনির কার্যক্ষমতার দুর্বলতার কারণে হয়
2. হাইপোফসফেটেমিক রিকেট হল একটি ভিটামিন ডি প্রতিরোধী রিকেট। রেনাল ফসফেট নষ্ট করা এটার দ্বিতীয় মুখ্য কারণ হলেও ফাইব্রোব্লাস্ট গ্রোথ ফ্যাক্টর-23 (বা FGF-23) প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
লক্ষণ
রিকেটের লক্ষণগুলি প্রায়শই শিশুদের মধ্যে সনাক্ত করা হয় এবং সেগুলি নীচে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
1. বাহু, পা, শ্রোণীদেশ, এমনকি মেরুদণ্ডের হাড়ে ব্যথা বা কোমলতা অনুভব।
2. শিশুর বৃদ্ধি বা উচ্চতায় ছোট আকারে সীমাবদ্ধ থাকা।
3. যদি কোন নরম হাড় থেকে থাকে তাহলে তা সহজেই ভেঙ্গে যায়।
4. হাড়ের ধীর বৃদ্ধি এবং পায়ের ধনুকাকৃতি।
5. যদি একটি শিশু পেশীর খিঁচুনি এবং অস্থি ভঙ্গ অনুভব করে।
6. যদি কোনও শিশুর দাঁতে বিকৃতি থাকে, যার মধ্যে পড়ে দাঁত উঠতে দেরি হওয়া, এনামেলে ছিদ্র হওয়া, ফোঁড়া, দাঁতের গঠনে ত্রুটি থাকা এবং দাঁতের গহ্বরের সংখ্যা বৃদ্ধি।
7. যদি কারো কঙ্কালের বিকৃতি থাকে যেমন তাদের মাথার খুলি অদ্ভুত আকৃতির হয় বা তাদের পাঁজরে ফোলা অংশ বা প্রসারিত স্তনের হাড় বা বাঁকা মেরুদণ্ড থাকে।
8. যদি একটি শিশুর একটি চওড়া কপাল এবং বিশালাকৃতির পেট থাকে।
কখন চিকিৎসকের সাথে যোগাযোগ করতে হবে?
রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা মারাত্মকভাবে কম হলে তাতে প্রায়ই স্বল্পমেয়াদী খিঁচুনি ব্যাথা, খিঁচুনি এবং শ্বাসকষ্টের মতো বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। চরম ক্ষেত্রে, দীর্ঘমেয়াদী পুষ্টিজনিত রিকেটগুলি হাড় সহজে ভাঙ্গার ঝুঁকি বাড়ায়, হাড়ের স্থায়ী বিষমাঙ্গ, হার্টের সমস্যা, নিউমোনিয়া এবং বাধাপ্রাপ্ত প্রসব এমনকি আজীবন অক্ষমতার ঝুঁকিও বাড়িয়ে দিতে পারে, যদি সময়মতো এর চিকিৎসা না করা হয়। সুতরাং, শিশুর মধ্যে রোগের লক্ষণগুলি সনাক্ত হওয়ার সাথে সাথে ডাক্তারের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
একটি শিশুর বেড়ে ওঠার সময় যদি রিকেটের চিকিৎসা না করা হয়, তাহলে এটি প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় শিশুটির দৈহিক আকার খুব ছোট হতে পারে। এই বিকৃতি স্থায়ী হতে পারে যদি ব্যাধিটির উপযুক্ত চিকিৎসা না করা হয়। ডাক্তার শিশুটির শারীরিক পরীক্ষা করে রিকেট নির্ণয় করেন। রক্তে ক্যালসিয়াম এবং ফসফেটের মাত্রা পরিমাপ করার জন্য রক্ত পরীক্ষা এবং হাড়ের বিকৃতি পরীক্ষা করার জন্য হাড়ের কাঠামোর এক্স-রে সহ রিকেট শনাক্ত করার জন্য ডাক্তার নির্দিষ্ট কিছু পরীক্ষার আদেশ দিতে পারেন।
রিকেটের জন্য দায়ী কারণ বা উপাদান
রিকেটের জন্য দায়ী অনেকগুলি কারণ রয়েছে এবং তাদের মধ্যে কয়েকটি হল:
1. ভিটামিন ডি এর অভাব: আমাদের শরীরের অন্ত্র থেকে ক্যালসিয়াম শোষণের জন্য ভিটামিন ডি এর প্রয়োজন। সূর্য থেকে আসা অতিবেগুনি রশ্মি ত্বকের কোষকে ভিটামিন ডি-এর পূর্ববর্তী একটি নিষ্ক্রিয় থেকে সক্রিয় অবস্থায় রূপান্তর করতে সাহায্য করে। সুতরাং, এর মানে হল যে কেউ যদি পর্যাপ্ত পরিমাণে ভিটামিন ডি গ্রহণ না করে, তবে তাদের শরীর তাদের গ্রহণ করা খাবার থেকে পর্যাপ্ত ক্যালসিয়াম শোষণ করতে পারে না, ফলে রক্তে ক্যালসিয়ামের মাত্রা দ্রুত হ্রাস পায়, তার জন্য হাড়ের দাঁতের নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি হয়।
•জিনগত কারণ: কিছু বিশেষ জিনগত অবস্থার কারণে কিছু ধরণের রিকেট হয়। এগুলিকে বেশিরভাগই বংশগত বলে মনে করা যেতে পারে। হাইপোফসফেটিমিক রিকেট হল বিক্ষিপ্ত অবস্থা যেখানে কিডনি পর্যাপ্ত পরিমাণে ফসফেট প্রক্রিয়া করতে অক্ষম হয়ে থাকে। প্রায় 20,000 নবজাতকের মধ্যে 1 জন সবচেয়ে সাধারণ এই ধরনের রিকেট দ্বারা প্রভাবিত হয়। ক্যালসিয়াম ব্যবহার করা নিয়ে শরীরের ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে জিনঘটিত কারণগুলি লিভার, কিডনি এবং অন্ত্রের কার্যকারিতাকে প্রভাবিত করে রিকেট সৃষ্টি করতে পারে।
রিকেটের চিকিৎসা
রিকেটের চিকিৎসা মূলত শরীরে অঅনুপস্থিত ভিটামিন বা মিনারেলের প্রতিস্থাপনের উপরই কেন্দ্রীভূত হয়। এটিই রিকেট এর সাথে সম্পর্কিত প্রায় সমস্ত লক্ষণগুলিকে দূর করে। উদাহরণ স্বরূপ, যদি কোনো শিশুর শরীরে ভিটামিন ডি-এর অভাব থাকে, তবে ডাক্তার সম্ভবত তাদের সূর্যালোকের সংস্পর্শে আসার সময় বাড়ানোর পরামর্শ দেবেন। শুধু তাই নয়, তাদের উচ্চ পরিমাণে ভিটামিন ডি অন্তর্ভুক্ত খাদ্য পণ্য যেমন মাছ, কলিজা, দুধ এবং ডিম খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ডি সম্পূরকগুলিও প্রায়শই বাচ্চাদের তাদের বয়সের উপর নির্ভর করে সঠিক মাত্রায় সরবরাহ করা হয়। যদি একটি শিশুর মধ্যে কঙ্কালের বিকৃতি থাকে, তবে সময়ের সাথে সাথে তাদের হাড়গুলি সঠিকভাবে অবস্থান করানোর জন্য তাদের সম্ভবত ব্রেসের প্রয়োজন হবে। সবচেয়ে চরম ক্ষেত্রে, শিশুটিকে সংশোধনমূলক অস্ত্রোপচারের মধ্য দিয়ে যেতে হতে পারে। বংশগত রিকেটের জন্য, রোগের চিকিৎসার জন্য ফসফেট সাপ্লিমেন্ট এবং উচ্চ মাত্রার ভিটামিন ডি একটি নির্দিষ্ট ফর্মের মিশ্রণ প্রয়োজন হয়ে থাকে।
উপসংহার
আমরা দেখেছি কিভাবে রিকেট একটি শিশুকে স্বল্পমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদী উভয় প্রক্রিয়াতেই প্রভাবিত করতে পারে। লক্ষণগুলি ছাড়াও রিকেটের ধরন এবং কারণগুলি নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। এটি লোকেদের একটি ন্যায্য ধারণা দেয় যে কীভাবে লক্ষণগুলি সনাক্ত করা যায় এবং তাদের কখন বাচ্চাদের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এখন, সরকারি হিসাবে রিকেটের ঘটনা বিরল, যেগুলিতে ভিটামিন ডি যুক্ত করার জন্য নির্দিষ্ট খাবারের প্রয়োজন হয়, তবে প্রতিবেদনগুলি দেখায় যে সেই দেশগুলিতেও আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েছে। উপসর্গগুলি উপেক্ষা করা হলে, তার প্রভাব প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত চলতে পারে এবং এটি থেকে অস্টিওম্যালাসিয়া হতে পারে, যা অনেকটা রিকেট এর মতোই। শিশুরা যদি অল্প বয়স থেকেই পর্যাপ্ত ভিটামিন ডি পায় এবং তাদের সঠিক যত্ন নেওয়া হয় তবেই এসব এড়ানো যেতে পারে। সুতরাং, এটি দেখাশোনা করা এবং তাদের সঠিক ওষুধ ও খাবার দেওয়া পিতামাতার দায়িত্বর মধ্যে পড়ে।
সচরাচর জিজ্ঞাস্য প্রশ্নাবলী
রিকেটের চিকিৎসার জন্য আমার কোন ধরনের ডাক্তারের কাছে যাওয়া উচিত?
প্রয়োজনে প্রথমে একজন সাধারণ চিকিৎসক, শিশু বিশেষজ্ঞ এবং তারপর একজন অর্থোপেডিক সার্জনের কাছে যাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়।
একটি শিশুর মধ্যে কত দ্রুত রিকেটের লক্ষণ দেখা যায়?
যদি একটি শিশু ধনুকাকৃতির পা বা অন্য কোনো শারীরিক বিকৃতির প্রবণতা দেখা যায়, তাহলে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞের সাথে অবিলম্বে দেখা করার পরামর্শ দেওয়া হয়। যদিও, প্রাথমিক পর্যায়ে লক্ষণগুলি সনাক্ত করতে, সাধারণ নিয়মমাফিক চেকআপই যথেষ্ট।
রিকেট প্রতিরোধের জন্য একটি শিশুকে কতক্ষণ সূর্যালোকের সংস্পর্শে রাখা উচিত?
ভারতের মতো একটি গ্রীষ্মমণ্ডলীয় দেশে সূর্যের সংস্পর্শে থাকা নিয়ে এতটা উদ্বেগ করা উচিত নয়। তবে, নাতিশীতোষ্ণ দেশগুলিতে, সূর্যের আলোর সংস্পর্শে প্রায় দুই থেকে তিন ঘন্টার জন্য থাকাই যথেষ্ট হওয়া উচিত।