হৃদপিণ্ড মানবদেহের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যা সারা শরীরে অক্সিজেনযুক্ত রক্ত সরবরাহ করে। এটি সংবহনতন্ত্রের মাধ্যমে রক্ত পাম্প করে। হৃদপিন্ডের পাম্পকেই মানুষের হৃদস্পন্দন বলা হয়। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য একটি সাধারণ হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে 60-100 বার হয়।
হৃদস্পন্দন বলতে আপনি কী বোঝেন?
একটি সাধারণ হৃদস্পন্দন মানে হৃদপিণ্ড যথাযথভাবে কাজ করছে এবং শরীরের সমস্ত অংশে অক্সিজেন রক্ত এবং খনিজ পদার্থ সরবরাহ করছে।
হৃদস্পন্দন একটি স্পন্দন দ্বারা পরীক্ষা করা হয়, যে আপনি আপনার তর্জনী এবং তৃতীয় আঙ্গুল আপনার কব্জিতে, ঘাড়ে ইত্যাদিতে রেখে অনুভব করতে পারেন। আপনাকে অবশ্যই এক মিনিটের জন্য স্পন্দন গুনতে হবে অথবা ১৫ সেকেন্ডের জন্য গুনে তাকে চার দিয়ে গুণ করে আপনার হৃদস্পন্দন বার করতে হবে। হৃদস্পন্দন মাপার সবচেয়ে সঠিক সময় হল ঘুম থেকে ওঠার পর।
হৃদস্পন্দন – কোনটি স্বাভাবিক নয়?
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন তখন হয় যখন হৃদপিণ্ড হয় খুব জোরে অথবা খুব ধীরে স্পন্দিত হচ্ছে। এটি একটি নির্দিষ্ট ছন্দ ছাড়াই অনিয়মিতভাবে স্পন্দিত হতে পারে। এটিকে অ্যারিথমিয়াস বলা হয়।
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন এর কিছু সাধারন ধরন হলো:
- ট্যাকিকার্ডিয়া: একটি শারীরিক অবস্থা যেখানে আপনার হৃদস্পন্দন সাধারণের থেকে দ্রুত হয়। এটিকে আরো ভাগে ভাগ করা যায় যেমন সুপ্রাভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া, ভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া, এবং সাইনাস ট্যাকিকার্নেয়া।
- ব্রাডিকার্ডিয়া: শারীরিক অবস্থা যা সাধারণ থেকে ধীর হৃদস্পন্দনের বিকাশ করে।
- ট্যাকিব্রাডি সিনড্রোম ( অসুস্থ সাইনাস সিনড্রোম) খুব দ্রুত অথবা ধীর হৃদস্পন্দনের দিকে পরিচালিত করে।
- অলিন্দের ফিব্রিলেশন হল সবচেয়ে সাধারণ অনিয়মিত, সাধারণত দ্রুত হৃদ ছন্দ।
- সুপ্রাভেন্ট্রিকুলার ট্যাকিকার্ডিয়া (SVT) হলো ভীষণ দ্রুত হৃৎস্পন্দন। বেশিরভাগ SVT গুলি অলিন্দ এবং নিলয়ের একটি অথবা একটির বেশি বৈদ্যুতিক পথের কারণে হয়।
- অলিন্দের ফ্লাটার হলো সাধারণত একটি দ্রুত হৃদের ছন্দ যেখানে অলিন্দের স্পন্দন নিলয়ের তুলনায় অনেক দ্রুত স্পন্দিত হয়। এটি অলিন্দকে দ্রুত স্পন্দিত করতে পারে, কখনো প্রতি মিনিটে 300 টি স্পন্দন।
- হৃদ ব্লক হৃদের ওপর এবং নিচের পরিবাহী ব্যবস্থার বন্ধ হওয়ার অথবা দেরি হওয়ার কারণে এটি হতে পারে, যা হৃদ স্পন্দনকে ধীর করে তোলে।
- নিলয়ের ফাইব্রিলেশন: একটি অবস্থা যেখানে হৃদ স্পন্দন যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার ফলে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট হতে পারে।
- অকাল সংকোচন : এটি হলো একটি অবস্থা যেখানে মনে হয় আপনার হৃদপিন্দ একটি স্পন্দন এড়িয়ে গেল।
এর উপসর্গগুলো কী কী?
যদি আপনার স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন না থেকে থাকে, আপনি একটি, কয়েকটি অথবা সবকটি নিম্নলিখিত উপসর্গগুলির বিকাশ ঘটাতে পারেন। সেগুলি হলো :
- মাথা ঘোরা
- অনিয়মিত স্পন্দন
- ঘাম হওয়া
- বুকে ব্যাথা
- নিঃশ্বাসে কষ্ট
- ত্বক ফ্যাকাশে হয়ে যাওয়া
হৃদস্পন্দনের জন্য কখন ডাক্তার দেখাতে হবে?
যদি আপনার স্বাভাবিক হৃদস্পন্দন না থাকে তাহলে আপনাকে অবশ্যই ডাক্তার দেখাতে হবে। প্রতি মিনিটে 100 বারের বেশি অথবা 60 বারের কম হলে আপনাকে অবশ্যই চিকিৎসা সাহায্য নিতে হবে। যদি আপনি মাথা ঘোরা অনুভব করেন অথবা নিঃশ্বাসের কষ্ট অনুভব করেন, আপনাকে অবশ্যই দ্রুত ডাক্তারের সাথে দেখা করতে হবে।
সাধারণ হৃদস্পন্দনকে প্রভাবিত করে এই কারণগুলি কী কী?
সাধারণ হৃদস্পন্দনকেকে প্রভাবিত করে তার বিভিন্ন কারণগুলির অন্তর্ভুক্ত হলো:
- আবহাওয়া – উচ্চ তাপমাত্রা এবং উচ্চ আদ্রতার স্তরে স্পন্দন কিছুটা বেশি হবে।
- হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়া– আপনি দাঁড়ানোর পর প্রথম কুড়ি সেকেন্ড অবধি হৃদস্পন্দন বেশি দেখাবে।
- আবেগ – চরম আবেগ যেমন খুশি, উদ্বেগ, চিন্তা এবং চাপ হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে তুলতে পারে।
- ঔষধ – যদি আপনি বিটা-ব্লকার জাতীয় ঔষধ নেন তবে আপনার হৃদস্পন্দন ধীর হতে পারে। আপনি প্রচুর থাইরয়েডের ঔষধ নিলে আপনার স্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের তুলনায় হৃদস্পন্দন কিছুটা বাড়তে পারে। এ সমস্ত আম্ফেটামাইনস এবং বেটা ব্লকার থাকা ওষুধের কিছু অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের কারণ হয় ।
- ক্যাফিন : কফি, চা এবং চকলেট থেকে আসা ক্যাফিন এবং নিকোটিনের কারণে সাধারণ হৃদস্পন্দন বাড়াতে দেখা গেছে।
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের ঝুঁকির কারণ গুলি কী কী?
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের জন্য অনেকগুলি ঝুঁকির কারণকে দায়ী করা যেতে পারে। সেগুলি হল:
- আগের হৃৎপিণ্ডের অবস্থা
- মধুমেহ এবং উচ্চ রক্তচাপ
- ধূমপান
- চাপ
- আসীন জীবনধারা
- ঔষধ- অ্যামফিটামিন এবং বিটা-ব্লকার জাতীয় ঔষধ গুলি হৃদস্পন্দন বাড়াতে এবং কমাতে পারে।
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের জটিলতা গুলি কী কী?
অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দন এর থেকে অনেক গুরুতর জটিলতা উঠে আসতে পারে। নিলয়ের ফাইব্রিলেশন এর কারণে কার্ডিয়াক্ অ্যারেস্ট হতে পারে। ব্রাডিকারদিয়া এবং ট্যাকিকার্ডিয়া দীর্ঘায়িত হলে আপনার হৃদযন্ত্র ব্যর্থ হতে পারে।
হৃদস্পন্দন সাধারণ স্তরে কীভাবে কমাতে হয়?
জীবনযাত্রার পরিবর্তন আপনার হৃদস্পন্দনকে কমাতে পারে। বিভিন্ন জীবনযাত্রার পরিবর্তন করা যায় যেমন:
- প্রতিনিয়ত ব্যায়াম: প্রতিনিয়ত ব্যায়াম করলে তা হৃদযন্ত্রের পেশীগুলিকে শক্ত রাখে এবং নিম্ন হৃদস্পন্দন রাখতে সাহায্য করে।
- সুস্থ খাদ্যাভ্যাস: অপ্রক্রিয়াজাত, সাধারণ এবং তেল ছাড়া খাবার দিয়ে তৈরি খাদ্যাভ্যাস একটি ভারসাম্যপূর্ণ খাদ্যাভ্যাস বজায় রাখতে সাহায্য করে। এটি শুধুমাত্র আপনার শরীরকে সুস্থ রাখে না এবং ওজনকেও উপযুক্ত সীমায় রাখে এবং হজমজনিত সমস্যা দূরে রাখে।
- মনের আরাম করার পন্থা : কিছু মন শিথিল করার পন্থা এবং ব্যায়াম মনকে শান্ত রাখে সাহায্য করে এবং হৃদস্পন্দন বৃদ্ধি করার চাপকে এড়িয়ে চলতে সাহায্য করে।।
- ধূমপান ছেড়ে দেওয়া: দেখা গেছে ধূমপান হৃদস্পন্দনকে বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে তাই ধূমপান ছেড়ে দিলে তাও অনিয়মিত হৃদস্পন্দনের জটিলতা বৃদ্ধি করা প্রতিরোধ করবে এবং এড়িয়ে চলবে।
সিদ্ধান্ত
একটি সাধারণ হৃদস্পন্দন বজায় রাখা খুবই প্রয়োজনীয়। এটি সুস্থ থেকে এবং স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে অর্জন করা যেতে পারে। এটি প্রয়োজনীয় কারণ আপনার হৃদস্পন্দন স্বাভাবিক থাকলে আপনি সবচেয়ে বেশি সুবিধা পাবেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন
রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দনের মধ্যে পার্থক্য কী?
রক্তচাপ এবং হৃদস্পন্দন হলো দুটি সম্পূর্ণ আলাদা। রক্তচাপ রক্তনালীর ভেতরে রক্তের শক্তিকে বলা হয়। হৃদস্পন্দন হল প্রতি মিনিটে স্পন্দনের পরিমাপ। তাই, দ্রুত হৃদস্পন্দন মানে উচ্চ রক্তচাপ নয়।
আপনার সর্বোচ্চ হৃদস্পন্দন কী হতে পারে?
একজন ব্যক্তির আনুমানিক সর্বোচ্চ হৃদস্পন্দন 220 থেকে বয়স বাদ দিয়ে গণনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ, একজন 60 বছর বয়সী ব্যক্তির সর্বোচ্চ হৃদস্পন্দন প্রতি মিনিটে 160 বার হতে পারে।
আপনি সর্বোচ্চ হৃদস্পন্দন একটি নির্দিষ্ট ব্যায়ামের সাহায্য জানতে পারেন যা হলো গ্রেডেড ব্যায়াম পরীক্ষা, যা ব্যায়ামের সময় রক্ত এবং অক্সিজেন পরিবাহিত করে।
একজন প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদের কম হৃদস্পন্দন হয় কেন?
একজন প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদের হৃদস্পন্দন মিনিটে 30-40 বার হয়। এটি কম বিশ্রামের হৃদস্পন্দন কারণ একজন প্রশিক্ষিত ক্রীড়াবিদ ব্যায়াম করেন যা তার হৃদপেশীকে শক্ত করে তোলে। এই প্রতি স্পন্দনের মাধ্যমে হৃদপিণ্ড বেশ কিছুটা আয়তনে রক্ত পাম্প করতে পারে।