আপনি কি কখনও একজন ব্যক্তিকে রোজকার ঘটা শব্দের প্রতিও তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখাতে দেখেছেন? জলের ফোঁটার শব্দ, খাবার চিবানোর, বা পেন্সিল টোকা দেওয়ার মতো শব্দগুলি কিছু মানুষকে বিরক্ত করে, যার ফলে তারা এদের প্রতি তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটিকে মিসোফোনিয়া বলা হয়, যা সিলেক্টিভ সাউন্ড সেনসিটিভিটি সিন্ড্রোম (এসএসএসএস বা 4এস) নামেও পরিচিত।
আপনার যদি মিসোফোনিয়া থাকে, তাহলে আপনার দৈনন্দিন ঘটা বিভিন্ন শব্দ থেকেও বিরক্ত, অস্বস্তি বা আতঙ্কিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এই শব্দগুলির কারণে একটি আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়াও ঘটে যেতে পারে। মিসোফোনিয়া অত্যন্ত বিরল কিন্তু বছরের পর বছর এটি স্থায়ী হতে পারে কিংবা সারাজীবনের ব্যাধিতে পরিণত হতে পারে।
মিসোফোনিয়া নিয়ে ধারণা
মিসোফোনিয়াকে মানসিক রোগ হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না। তবে উদ্বেগ এবং রাগের সাথে এটির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। বিরক্তি উদ্রেককারী শব্দগুলি একটি মানসিক অবস্থা এবং কিছু ক্ষেত্রে, একটি শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করতে পারে। আপনার মতো একই পরিস্থিতির সাক্ষী থাকা অন্যান্য লোকেরা এটিকে অযৌক্তিক বলে মনে করতে পারে, কিন্তু আপনার মধ্যে আক্রমণাত্মক, আতঙ্কিত বা বিরক্ত হওয়ার প্রবণতা দেখা যাবে।
আপনার প্রতিক্রিয়াগুলি আবার, কীভাবে শব্দটি আপনার প্রতিক্রিয়াগুলিকে উদ্দীপ্ত করছে তার উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হতে পারে। অন্য ব্যক্তির করা মৌখিক শব্দ, যেমন খাওয়া, শ্বাস নেওয়া, বা চিবানোর শব্দ কিংবা ঘোরাঘুরির শব্দ বা পায়ের নড়াচড়া করার মতো কিছু শব্দও মিসোফোনিয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তিকে অধৈর্য্য করে তুলে প্রতিক্রিয়া জানাতে প্ররোচিত করে তোলে।
শব্দের গতির তীব্রতা অনেকসময় এটির প্রতি তাদের প্রতিক্রিয়াশীলতা বাড়াতে পারে। আপনি শব্দ সহ পুনরাবৃত্তিমূলক কিছু চাক্ষুষ উদ্দীপনার মাধ্যমে উত্তেজনা অনুভব করতে পারেন।
মিসোফোনিয়ার লক্ষণগুলো কী কী?
আপনি যদি কিছু ধরণের শব্দ বা চাক্ষুষ উদ্দীপনা সহ শব্দের দ্বারা উদ্দীপিত বোধ করেন তবে আপনার প্রতিক্রিয়াগুলির মাত্রা মাঝারি থেকে গুরুতর পর্যন্ত হতে পারে। ডাক্তাররা বিভিন্ন ধরণের মানসিক এবং শারীরবৃত্তীয় প্রতিক্রিয়া নথিবদ্ধ করেছেন। মিসোফোনিয়ার প্রাথমিক লক্ষণগুলি নিম্নলিখিত :
- আপনি উদ্বিগ্ন বোধ করতে পারেন
- আপনার পালানোর তীব্র ইচ্ছা হতে পারে এবং অস্বস্তি বোধ করতে পারে
- অনেকের মধ্যে বিতৃষ্ণার অনুভূতিও দেখা যায়
বিজ্ঞানীদের প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে এই লক্ষণগুলি মেয়েদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, বিশেষত নয় থেকে তেরো বছর বয়সের মধ্যে কিংবা বয়ঃসন্ধির বয়সের মধ্যে।
কখন ডাক্তার দেখাবেন?
আপনি যখনই অনুভব করবেন যে আপনার প্রতিক্রিয়াগুলি গুরুতর হয়ে উঠছে তৎক্ষণাৎ ডাক্তারের সাথে দেখা করা উচিত। এই প্রতিক্রিয়াগুলির মধ্যে মধ্যে রয়েছে:
- ক্ষিপ্ততা এবং রাগের অনুভূতি,
- আপনার যদি অন্য ব্যক্তির প্রতি ঘৃণা তৈরি হয়,
- যদি আপনি আতঙ্কিত বোধ করেন বা ভয় পান, এবং
- আপনি যদি মানসিক যন্ত্রণার সম্মুখীন হন
এই ব্যাধিটি মানসিক অসুবিধা হিসাবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয় না তবে এটি আপনার সামাজিক জীবনকে দুর্বিষহ করে তুলতে পারে। আপনার মধ্যে সামাজিক জমায়েত, পারিবারিক নৈশভোজ বা এমনকি একই ঘরের বাসিন্দাদেরও এড়িয়ে যাবার প্রবণতা দেখা যেতে পারে এবং গোলমাল-মুক্ত এবং শান্ত পরিবেশের প্রতি আপনার ভালোলাগা বেড়ে যেতে পারে। অধৈর্য্যভাবে প্রতিক্রিয়া জানান দেবার ভয় আপনাকে বিষণ্নতায় ডুবিয়ে দিতে পারে।
আপনি যদি আপনার জীবনে এই ধরণের পরিস্থিতির শিকার হন, তবে অবিলম্বে আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করুন।
মিসোফোনিয়ার কারণ কী?
মিসোফোনিয়ার সুনির্দিষ্ট কারণ এখনও পর্যন্ত জানা যায়নি। কিন্তু ডাক্তাররা নিশ্চিত করেছেন যে মিসোফোনিয়া কোন শ্রবণ ব্যাধি (আপনার কানের সমস্যা) বা সম্পূর্ণরকম মানসিক সমস্যাও নয়। এটি আংশিকভাবে একটি মানসিক এবং শারীরিক অসুস্থতা হিসাবে বিবেচিত হয়, যা মস্তিষ্ক-ভিত্তিক ব্যাধি হিসাবেও পরিচিত। অনেক ক্ষেত্রে, মিসোফোনিয়া উদ্বেগজনিত ভারসাম্যহীনতার সাথে দেখা দেয় যেমন-
- অবসেসিভ-কম্পালসিভ ডিসঅর্ডার (ওসিডি)
- ট্যুরেট এর ডিসঅর্ডার
- অ্যানোরেক্সিয়া নার্ভোসা (স্ব ইচ্ছায় উপোষী থাকা) এবং বুলিমিয়া নার্ভোসা (বেশী পরিমাণে খাবার খাওয়া) এর মতো খাওয়া সংক্রান্ত উপসর্গ হতে পারে।
মিসোফোনিয়া এর জটিলতা কী কী?
মিসোফোনিয়া কোনো নির্দিষ্ট বা গুরুতর ব্যাধির সূত্রপাত করবে না। বরং এটিতে, আপনার জীবনযাপনের পদ্ধতি এবং পরিস্থিতির প্রতি প্রতিক্রিয়া পরিবর্তনের সম্ভাবনা বেশি।
• আপনি বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষামূলক বা আক্রমণাত্মক প্রতিক্রিয়া পেতে পারেন।
• আপনি আপনার পরিবার এবং বন্ধুদের থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চান এবং সামাজিকতা থেকে দূরে থাকতে চাইতে পারেন।
মিসোফোনিয়া রোগীদের জন্য চিকিৎসা পরিকল্পনা কী?
মিসোফোনিয়া আপনার দৈনন্দিন জীবনের কাজগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে, তবে আপনাকে অবশ্যই ধৈর্য্যের সাথে এটি মোকাবিলা করা শিখতে হবে। এখানে কিছু চিকিৎসা পরিকল্পনা রয়েছে যা আপনার ডাক্তার আপনাকে মেনে করার পরামর্শ দেবেন:
• শব্দ থেরাপির জন্য একজন অডিওলজিস্ট।
•আপনি শ্রবণযন্ত্রের সাহায্যকারী যন্ত্র ব্যবহার করে দেখতে পারেন, যা শক্তিশালী প্রতিক্রিয়া জাগানো আওয়াজগুলি আটকাতে সক্ষম৷
• টিনিটাস রিট্রেনিং থেরাপি (টিআরটি) – আপনাকে উচ্চমাত্রার শব্দ সহ্য করার জন্য বলা হবে এবং সাধারণত এর প্রতি প্রতিক্রিয়া দেখাতে হবে।
•জ্ঞানীয়-আচরণগত থেরাপি (CBT) – এই থেরাপি আলোচনা এবং পরামর্শের উপর দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। আপনার সহায়ক কাউন্সেলিংয়ে অংশ নেওয়া উচিত, যেখানে মোকাবিলার কৌশলগুলির উপর মনোযোগ দেওয়া হয়।
•সাইকোথেরাপিউটিক হিপনোথেরাপি
•নিয়মিত ব্যায়াম এবং পর্যাপ্ত ঘুম আপনার উদ্বেগ এবং মিসোফোনিয়া নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করবে।
• আপনার পরিবারের সদস্যরা আপনাকে একটি শব্দহীন পরিবেশ গঠনে সহায়তা করতে পারে, যেখানে কোনো শব্দ আপনাকে বিরক্ত করবে না।
এখন পর্যন্ত, মিসোফোনিয়ার চিকিৎসার জন্য কোনো ফার্মালজিক্যাল পদ্ধতি নেই।
আপনি কিভাবে মিসোফোনিয়া নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন?
মিসোফোনিয়া হল স্ব-নির্ণয়যোগ্য, এবং একজন ব্যক্তির এর উত্তেজনা বা প্রতিক্রিয়ার তীব্রতা বিচার করার জন্য যথেষ্ট উপলব্ধি থাকে। মিসোফোনিয়া নিয়ন্ত্রণের কয়েকটি সাধারণ পদ্ধতি হল:
- জনাকীর্ণ স্থান এড়ানোর চেষ্টা করুন এবং শব্দ-আটকাতে সক্ষম হেডফোন পরা শুরু করুন।
- মানসিক উদ্বেগের সাথে মোকাবিলা করা বা এর জন্য সহায়তা নেওয়া আপনাকে মিসোফোনিয়ার উপসর্গগুলি উপশম করতে এবং প্রতিরোধ করতে সহায়তা করবে।
- উদ্বেগের সাথে সম্পর্কিত পরিস্থিতি মোকাবিলা করার জন্য একটি সহায়তাকারী পরিবার এবং একটি বোঝার মতো বন্ধুর ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
মিসোফোনিয়ায় আক্রান্ত লোকেরা বিভিন্ন শব্দের প্রতি দৃঢ় এবং ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখায়। এটি একটি মস্তিষ্ক-ভিত্তিক ব্যাধি যার কোনো ফার্মালজিক্যাল চিকিৎসা এখনও প্রস্তাবিত হয়নি। উদ্বেগজনিত ব্যাধি এবং টিনিটাসে আক্রান্ত ব্যক্তিরা প্রায়শই এই বিরল ব্যাধিতে আক্রান্ত হন। এর চিকিৎসার জন্য একজন ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করা গুরুত্বপূর্ণ। থেরাপির মাধ্যমে, আপনি মিসোফোনিয়া নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি শিখতে পারেন।
সচরাচর জিজ্ঞাসিত প্রশ্নাবলী
1. মিসোফোনিয়া কি জেনেটিক? আমি কি আমার পিতামাতার কাছ থেকে এটি পেতে পারি?
হ্যাঁ, বিভিন্ন তত্ত্ব থেকে প্রকাশিত হয়েছে যে মিসোফোনিয়ার সাথে একটি জিনগত উপাদান যুক্ত রয়েছে। যদিও, এটি সম্পূর্ণরূপে বোঝা যায়নি, তবে এটি বিশ্বাস করা হয় যে মিসোফোনিয়া বিভিন্ন জিনের মিথস্ক্রিয়ার জন্য সৃষ্ট এবং শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট জিন দায়ী নয়। হয়তো আপনার কাছে এর জিন থাকতে পারে, তবে আপনার অতীত জীবনের অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে, আপনার মধ্যে এই ব্যাধিটির লক্ষণগুলি দেখা যেতে পারে বা নাও যেতে পারে।
2. মিসোফোনিয়া কি একটি ফোবিয়া?
না, ফোনোফোবিয়া বা শব্দভীতির সাথে মিসোফোনিয়া কোনোভাবেই যুক্ত নয়। মিসোফোনিয়া হল শব্দের প্রতি ঘৃণা, যেখানে ফোনোফোবিয়া হল শব্দকে নিয়ে ভয়। অনেক রোগীর ক্ষেত্রে এই দুইয়ের মধ্যে ভুল নির্ণয় ঘটে যায়। এই দুটি অবস্থার মধ্যে মিল প্রমাণ করা নিয়ে কোন প্রমাণ বা গবেষণার অস্তিত্বই নেই। একটি হল শব্দের প্রতি ঘৃণা, এবং অন্যটি ভয়ের অনুভূতি।