একটি সুষম খাদ্য তালিকায় একজন মানুষের বয়স এবং শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী শরীরে প্রয়োজনীয় সব ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে । তন্তুযুক্ত খাবার আমাদের রোজকার খাবারের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটি আমাদের পাচনতন্ত্রকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। অন্যান্য পুষ্টি উপাদানের মতো এটি শরীরের কোশ গুলি দ্বারা শোষিত হয় না এবং ভেঙে যায় না। এইভাবে, এটি পরিপাকতন্ত্র থেকে কোলন এবং মলদ্বারে প্রবেশ করে, আমাদের শরীর থেকে মলের মাধ্যমে পরিত্যাগকারী দ্রব্যের অংশকে বাড়িয়ে দেয়।
50 বছরের নীচে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষের প্রতিদিন 38 গ্রাম এবং পঞ্চাশের অধিক একজন পুরুষের প্রতিদিন 30 গ্রাম তন্তু প্রয়োজন। 50 বছরের নিচে একজন প্রাপ্তবয়স্ক মহিলার প্রতিদিন 25গ্রাম তন্তু এবং পঞ্চাশের অধিক একজন মহিলার প্রতিদিন 21গ্রাম তন্তু প্রয়োজন। এই কারণে আপনার তন্তু সমৃদ্ধ হোল গ্রেনযুক্ত খাদ্য-শস্য, বাদাম, টাটকা ফল এবং সব্জি খাওয়া উচিত।
বিভিন্ন ধরনের খাদ্যতালিকাগত তন্তু
অদ্রবণীয় তন্তু: জল বা অন্য কোন তরলে মিশে যায় না এরকম তন্তু হল সেলুলোজ, লিগনিন এবং হেমিসেলুলোজ। তাই এই তন্তুগুলিকে বলা হয় অদ্রবণীয়, এটি মলের পরিমাণ বাড়াতে প্রয়োজন। সাধারণত হোল গ্রেন খাদ্যশস্য, বাদাম, গমের ভুসি, ধানের তুষ, মটরশুঁটি, আলু, ফুলকপি, কিছু সবজির খোসা এবং ফলে সবথেকে বেশি পরিমাণে অদ্রবণীয় তন্তু পাওয়া যায়। যে সমস্ত রোগীদের কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অন্যান্য হজমের সমস্যা আছে, তাদের ডাক্তাররা এই ধরনের খাবার খেতে বলেন।
দ্রবণীয় তন্তু: পেকটিন, মিউসিলেজ এবং গাম হল জলে দ্রবণীয় তন্তু, একে জলে মেশালে জেলের মত মোটা দ্রব্য তৈরি হয়। রক্তে শর্করার এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমানোর জন্য ডাক্তাররা এই তন্তুগুলি খেতে বলেন। তিসির বীজ, যব, মুসুর ডাল, ইসবগুল, শুকনো মটরশুঁটি, যবের ভুষি, সয়াবিন, ফল এবং সবজিতে এই ধরনের তন্তু থাকে।
কোন কোন খাবারে সহজে তন্তু পাওয়া যায়?
- মটরশুটি, সিম এবং মসুর ডাল
- ব্রোকলি, গাজর এবং বিট
- ব্রাউন রাইস, বাজরা, গমের ভুষি, ওটস এর মতো হোল গ্রেইন
- আপেল, কলা, অ্যাভোকাডো, পেয়ারা, আঙুর
- শুকনো ফল, বীজ, বাদাম
তন্তু যুক্ত খাবারের উপকারিতা কী?
মলত্যাগ সহজ করে: তন্তু যুক্ত খাবার মলকে নরম করতে সাহায্য করে, এতে মলত্যাগে সুবিধা হয়। তন্তু মল থেকে অতিরিক্ত জল শুষে নেয় এবং মলের পরিমাণ বাড়াতে সাহায্য করে।
পাচনতন্ত্রকে সুস্থ রাখে: যে সমস্ত রোগীদের কোষ্ঠকাঠিন্য আছে তাদের তন্তুযুক্ত খাবার খুবই প্রয়োজনীয়। অর্শ্ব, কোলোরেক্টাল ক্যান্সার প্রভৃতি রোগের ক্ষেত্রে এই তন্তুগুলি প্রতিদিন খাওয়া খুবই প্রয়োজন।
কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়: তন্তু যুক্ত খাবার রক্তে কোলেস্টেরলের এবং লিপোপ্রোটিনের মাত্রা কমায়। সাধারণত তিসি বীজ, ওটস এবং মটরশুটিতে দ্রবণীয় তন্তু থাকে যা এক্ষেত্রে সাহায্য করে।
শর্করার মাত্রা ঠিক রাখে: ডায়াবেটিক রোগীরা তাদের রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে পারে প্রতিদিন তাদের খাদ্যতালিকায় দ্রবণীয় তন্তুযুক্ত খাবার রেখে। এই তন্তু রক্তে শর্করার মাত্রা কমায়, ফলে শরীরেও শর্করার মাত্রা কমে।
ওজন কমাতে সাহায্য করে: খাদ্য বিশেষজ্ঞরা স্থূল রোগীদেরকে তন্তুযুক্ত খাবার খেতে বলেন ওজন কমানোর জন্য। তন্তুতে পেট ভরে যায় এবং অনেকক্ষণ তা পেট ভর্তি রাখে। এর ফলে বারবার খিদে পায় না এবং এটি ওজন কমাতে সাহায্য করে। বেশিরভাগ তন্তু যুক্ত খাবারেই খুব কম ক্যালোরি থাকে।
আয়ুষ্কাল বৃদ্ধি করে: তন্তুযুক্ত খাবার ক্যান্সার এবং বিভিন্ন ধরনের হৃদপিণ্ডের রোগ হওয়ার সম্ভাবনা কমায়। অতএব প্রতিদিন তন্তু যুক্ত খাবার খেলে জীবনকাল বৃদ্ধি হতে পারে।
যেগুলি দেখলে বোঝা যাবে আপনার খাবারে কম তন্তু আছে
এখানে কয়েকটি উপসর্গ দেওয়া হল যেগুলি যদি আপনার প্রতিদিনকার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ তন্তু না থাকে, তবে তা আপনার হতে পারে। নিম্নলিখিত যে কোনো একটি উপসর্গ যদি আপনার হয় তাহলে আপনাকে এই মুহূর্ত থেকে তন্তুযুক্ত খাবার গ্রহণ করতে হবে।
- কোষ্ঠকাঠিন্য: মলত্যাগ করতে কষ্ট হওয়া এবং নিয়মিত মলত্যাগ না হওয়া কোষ্ঠকাঠিন্যের প্রধান লক্ষণ। যদি আপনার এই সমস্যা দেখা দেয় তাহলে হলে বুঝতে হবে আপনার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ তন্তু নেই।
- অতিরিক্ত ওজন: যদি আপনার পেট সহজে না ভরে, তাহলে বুঝতে হবে আপনার খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণে তন্তু নেই। এর ফলে আপনি বারবার খেতে থাকেন এবং আপনার ওজন বেড়ে যায়।
- ক্লান্তি: খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ তন্তু না থাকলে সামান্য কাজ করেই আপনি ক্লান্তি অনুভব করবেন।
- রক্তে শর্করার মাত্রা বৃদ্ধি: খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ তন্তু না থাকলে রক্তে শর্করার মাত্রা ওঠানামা করে। ডায়াবেটিক রোগীদের ক্ষেত্রে এই উপসর্গ আরও বেশি দেখা যায়, তাই তন্তু যুক্ত খাবার না খেলে রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না।
কম তন্তুযুক্ত খাবার খাওয়ার ফলে যে সমস্ত রোগ হয়
- তন্তুযুক্ত খাবার না খেলে হজমের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য এবং অনিয়মিত মলত্যাগের মতো সমস্যা দেখা দেয়। কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে পেট ভার-ভার হয় এবং গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল ট্র্যাকে ব্যথা হয়।
- খাবারে পর্যাপ্ত পরিমাণ তন্তু না থাকলে ডায়ারিয়া এবং পেট খারাপের মত রোগ দেখা দেয়। তন্তুযুক্ত খাবার না খেলে পরিপাক নালীতে অতিরিক্ত তরল থেকে যায় ফলে এই রোগ দেখা দেয়।
- তন্তুযুক্ত খাবার না খাওয়ার ফলে ডাইভার্টিকিউলোসিস বা অন্ত্রের প্রাচীরে ছোট ছোট থলি দেখতে পাওয়া যায়। এটি একটি দুরারোগ্য বিরল রোগ।
- অনিয়মিত মলত্যাগ এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের ফলে কোলন ক্যান্সারও হয়। আপনি আপনার রোজকার খাবারে তন্তুযুক্ত খাদ্যশস্য, ফল এবং সবজি রেখে এটিকে প্রতিরোধ করতে পারেন।
- বেশিরভাগ তন্তুযুক্ত খাবারে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীরের প্রদাহের সাথে লড়াই করে। যদি আমরা তন্তুযুক্ত খাবার না খাই তাহলে এটি প্রতিরোধ করা যাবে না।
- রোজকার খাবারে তন্তু না থাকলে যে রোগ হয় তার মধ্যে অন্যতম হলো স্থূলতা। তন্তুযুক্ত খাবারে কোন ক্যালোরি এবং ফ্যাট থাকে না। ফলে ওজনও বেড়ে যায় না।
উপসংহার
প্রতিদিন তন্তু যুক্ত খাবার খেলে অনেক রোগ প্রতিরোধ করা যায়। কতটা পরিমাণ তন্তু আপনার গ্রহণ করা উচিত এই ব্যাপারে আপনি আপনার ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে পারেন।
প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন (FAQs)
- রোজকার খাবারে কীভাবে তন্তুের পরিমাণ বাড়ানো যায়?
প্রত্যেক দিনের খাবারে দুটি ভিন্ন ধরনের শাকসবজি এবং তন্তু যুক্ত একটি ফল রাখতে হবে।
- কোন তন্তুযুক্ত খাবার আমরা প্রাতঃরাশে খেতে পারি?
ওটস, আপেল, আঙুর এবং দই প্রাতঃরাশে খাওয়া যেতে পারে কারণ এইগুলিতে ভালো পরিমাণ তন্তু থাকে।
- বেশি তন্তুর জন্য গাঢ় রঙের খাবার কি আমাদের খাওয়া উচিত?
ব্রোকলি, বিট এবং গাজর প্রভৃতি গাঢ় রঙের সবজিগুলিতে পর্যাপ্ত পরিমাণে তন্তু থাকে। এমনকি আর্টিচোকেও ভালো পরিমাণে তন্তু পাওয়া যায়।